লিভার সুস্থ রাখার সহজ উপায়! যে খাবার লিভার পরিষ্কার রাখে !
কনটেন্ট টেবিল
লিভার মানবদেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ এবং একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির লিভারের ওজন তিন পাউন্ড। দেহের এই লিভার অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কাজের সঙ্গে জড়িত।
যেমন- হজম শক্তি, মেটবলিজম, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি, দেহে পুষ্টি যোগানো ইত্যাদি। সুস্থ লিভার দেহের রক্ত প্রবাহ নিয়ন্ত্রন করে, রক্ত থেকে ক্ষতিকর টক্সিন বের করে দেয়, দেহের সকল অংশে পুষ্টি যোগায়। এ ছাড়াও লিভার ভিটামিন, আয়রন এবং সাধারণ সুগার গ্লুকোজ সংরক্ষন করে।
যেহেতু লিভার আমাদের দেহের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ তাই যে কোন উপায়ে একে সুস্থ সবল রাখতে হবে। অস্বাস্থ্যকর জীবন যাপন দেহের লিভারের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে।
ওজন বৃদ্ধি, হৃদরোগ, দীর্ঘ সময় ক্লান্তি অনুভব করা, হজমের সমস্যা, এলার্জি ইত্যাদি অসুখ দেখা দিতে পারে লিভারের অসুস্থতার কারণে। তাই দেহ ও লিভার সুস্থ রাখার জন্য চিনে নিন এমন কিছু খাবার, যা আপনাকে সুস্থ রাখবে।
(i) রসুন: প্রতিদিন যে কোন সময় ২/৩ টি রসুনের কোয়া খেয়ে নিন। লিভার পরিষ্কার রাখার জন্য উত্তম খাবার রসুন। এর এনজাইম লিভারের ক্ষতিকর টক্সিক উপাদান পরিষ্কার করে। এতে আছে আরও দুটি উপাদান যার নাম এলিসিন এবং সেলেনিয়াম। যা লিভার পরিষ্কার রাখে এবং ক্ষতিকর টক্সিক উপাদান হতে রক্ষা করে।
(ii) লেবু: লেবুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদান দেহের লিভার পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে এবং ডি লিমনেন উপাদান লিভারে এনজাইম সক্রিয় করে। তা ছাড়া লেবুর ভিটামিন সি লিভারে বেশি করে এনজাইম তৈরি করে, যা হজম শক্তির জন্য উপযোগী। লেবুর মিনারেল লিভারের নানান পুষ্টি উপাদানগুলো শোষণ করার শক্তি বৃদ্ধি করে। প্রতিদিন লেবুপানি পান করুন, চাইলে মধুও মিশিয়ে নিতে পারেন।
(iii) আপেল: প্রতিদিন একটি করে আপেল খেলে তা লিভারকে সুস্থ রাখে। আপেলের পেক্টিন ফাইবার, দেহের পরিপাক নালী হতে টক্সিন ও রক্ত হতে কোলেস্টোরল দূর করে এবং সাথে সাথে লিভারকেও সুস্থ রাখে।আপেলে আরও আছে ম্যালিক এসিড। যা প্রাকৃতিকভাবেই রক্ত হতে ক্ষতিকর টক্সিন দূর করে। যেকোন ধরণের আপেলই দেহের লিভারের জন্য ভালো। তাই লিভার সুস্থ রাখতে প্রতিদিন একটি করে আপেল খান।
লিভার রোগ মানেই যেন আঁৎকে উঠা। অন্য কোন রোগে যেমন-তেমন, লিভারে অসুখ হয়েছে মনে করলেই মনে নানা অজানা আশঙ্কা উঁকি-ঝুঁকি দেয়। আর চারপাশের সবাই হয়ে উঠেন একেকজন লিভার বিশেষজ্ঞ। এটা করতে হবে, ওটা করোনা জাতীয় পরামর্শ আসতে থাকে ক্রমাগত।
বিশেষ করে কি খেতে হবে আর কি খাওয়া যাবে না এই নিয়ে পরামর্শের যেন শেষ থাকে না। প্রতিদিন লিভার রোগীদের চিকিৎসা করতে যেয়ে যে জিনিসটা মনে হয় তা হলো এ ধরনের রোগীরা তাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খুবই বিভ্রান্তিতে থাকেন।
বিশেষ করে লিভার বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলতে যেয়ে তাদের বিভ্রান্তি অনেক ক্ষেত্রেই বেড়ে যায়। কারণ লিভার রোগীর পথ্যের ব্যাপারে আমাদের যে প্রচলিত বিশ্বাস তা অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাথে খাপ খায় না।
চোখ হলদে হয়:
ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের লিভার ট্রান্সপ্লান্টেশনের মেডিক্যাল পরিচালক ডা. কেভি নারায়ানান মেনন বলেন, হলদে চোখ হল একটি উপসর্গ যাতে বুঝা যায় যে লিভার ভালোমতো কাজ করছে না এবং এটি সম্ভবত লিভার ডিজিজ বা যকৃত রোগের সবচেয়ে নির্দিষ্ট উপসর্গ।
বিলিরুবিন নামক হলুদ রঙয়ের একটি পদার্থ সাধারণত লিভার দ্বারা বিকল হয়ে শরীর থেকে অপসারিত হয়ে যায়। কিন্তু লিভারে সমস্যা হলে শরীরে বিলিরুবিন পুঞ্জিভূত হতে থাকে যা চোখের সাদা অংশকে হলদে করে তোলে।
পেট তরলে ভরে যায়:
আপনার পেট যদি হঠাৎ ফুলে যায় এবং তা যদি না থামে, তাহলে এটি সাধারণ ব্লোটিং বা পেট ফোলার চেয়েও বেশি ফুলে যেতে পারে। ডা. মেনন বলেন, লিভারের আশেপাশের রক্তনালীসমূহের মধ্যে বর্ধিত চাপ পেটের ভেতর তরল জমা করতে পারে।
গ্যাস, খাবার কিংবা তরলের কারণে আপনার পেট ফুলে গেছে কিনা জানতে ডাক্তার দেখানো গুরুত্বপূর্ণ।
আপনার হেপাটাইটিস এ, বি অথবা সি আছে:
ভাইরাস অথবা প্যারাসাইট বা পরজীবী বা জীবাণু দ্বারা লিভার সংক্রমিত হলে লিভারে প্রদাহ হয় এবং লিভারের কার্যক্ষমতা কমে যায়। লিভার ইনফেকশন বা যকৃত সংক্রমণের সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ধরন হল, হেপাটাইটিস ভাইরাস।
আক্রান্ত ব্যক্তির মলের সংস্পর্শে আসলে অথবা দূষিত খাবার ও পানি শরীরে গ্রহণ করলে হেপাটাইটিস এ ছড়ায়। অন্যদিকে হেপাটাইটিস বি এবং সি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে রক্ত, যৌন মেলামেশা এবং অন্যান্য শারীরিক তরলের মাধ্যমে দেহে প্রেরিত হতে পারে।
ডা. মেনন বলেন, হেপাটাইটিস সি এর জন্য ভালো চিকিৎসা আবিষ্কার হয়েছে, তাই লোকজনের হেপাটাইটিস সি আছে কিনা পরীক্ষা করা উচিত। লিভার সুস্থ রাখার বিষয় সম্পর্কে জানতে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন।
চুলকানি থামাতে পারেন না:
আপনি বিশ্বাস করুন কিংবা না করুন, একটি অসুস্থ লিভার শরীরের সর্বত্র চুলকানির উদ্রেক করতে পারে। ডা. মেনন বলেন, আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না, কিন্তু এটি বাইল সল্ট বা পিত্ত লবণের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়।
পিত্ত হচ্ছে লিভার দ্বারা উৎপাদিত পাচন পদার্থ, কিন্তু প্রাইমারি বিলিয়ারি সিরোসিস (একটি অটোইমিউন যকৃত রোগ যা বাইল ডাক্ট বা পিত্তনালীকে বন্ধ করে দেয়) রোগে আক্রান্তদের মধ্যে পিত্ত জমা হতে থাকে এবং শরীরে উল্লেখযোগ্য উপসর্গ (যেমন- চুলকানি) দেখা দেয়।
রতিনিয়ত ক্লান্ত থাকেন:
দীর্ঘায়িত ক্লান্তি এমন একটি উপসর্গ যা প্রায় সবসময় শরীর যে ভালো নেই তা নির্দেশ করতে পারে। লিভার ডিজিজ বা যকৃত রোগ হলেও প্রতিনিয়ত ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন।
অতিমাত্রায় মদ্যপ থাকেন:
অতিরিক্ত ও দীর্ঘমেয়াদে অ্যালকোহল সেবনে লিভারের অনেক ক্ষতি হতে পারে, এমনকি শেষপর্যন্ত যকৃত রোগও হতে পারে। লিভার শরীরের কেমিক্যাল ও টক্সিন দূরীকরণে সাহায্য করে, তাই প্রতিনিয়ত মদ্যপানে এটিকে পাম্পিং করার মানে হল এটিকে ওভারটাইম কর্মে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে।
প্রয়োজনাতিরিক্ত ওজনের অধিকারী:
অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা আপনাকে আয়নায় যেমনভাবে দেখায় তার চেয়েও বেশি শরীরে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, চল্লিশোর্ধ্ব এবং পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ বা অ্যালকোহলমুক্ত মেদবহুল যকৃত রোগ বেড়ে যায়, যা মূলত লিভারে চর্বি জমার কারণে হয়ে থাকে। মাঝেমাঝে এ কারণে সিরোসিস বা লিভারে ক্ষত হতে পারে।
সুখবর হল আপনি এ রোগ বা স্থূলতা, উচ্চ কোলেস্টেরল এবং ডায়াবেটিস বিকাশের ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়সমূহ নিয়ন্ত্রণ বা পরিবর্তন করতে পারবেন।
যকৃত রোগের পারিবারিক ইতিহাস আছে:
ডা. মেনন বলেন, ছোট শ্রেণীর যকৃত রোগ বংশগতভাবে হয়ে থাকে, তাই আপনার পরিবারের কোনো সদস্য বা একাধিক সদস্য যকৃত রোগ বা লিভার ক্যানসারে মারা গিয়ে থাকলে ডাক্তারের সামনে প্রকাশ করুন, যাতে তিনি আরো ভালোভাবে আপনার যকৃত রোগ পর্যবেক্ষণ করতে পারেন।
বুদ্ধিভ্রষ্ট বা বিস্মরণপ্রবণ:
সামান্য বিস্মরণ বা ভুলে যাওয়া ভালো বিষয় বলে বিবেচিত, কিন্তু হঠাৎ করে সবকিছু ভুলে যাওয়া কিংবা সহজেই বুদ্ধিভ্রষ্টতাকে অনপকারী ব্রেইন ফার্ট (সাময়িক বিস্মরণ) ভাববেন না।
হেপাটিক এঞ্চেফ্যালোপ্যাথি (রক্ত থেকে টক্সিন অপসারণে লিভারের ব্যর্থতার ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া) হচ্ছে, এমন এক অবস্থা যা লিভার শরীর থেকে টক্সিন দূর করতে অসমর্থ হলে হয়ে থাকে এবং তা সাধারণত সেসব রোগীদের হয়ে থাকে যাদের দীর্ঘস্থায়ী যকৃত রোগ, সিরোসিস অথবা হেপাটাইটিস আছে।
লিভার সুস্থ রাখার ঘরোয়া উপায়:
লেবুপানি : প্রতিদিন লেবু পানি পানের অভ্যাস করুন। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন- সি থাকে, যা লিভারকে দূষণমুক্ত করতে সাহায্য করে।
গ্রিন-টি : প্রতিদিন সকালে ও বিকালে এক কাপ করে গ্রিন-টি পান করুন। এটি লিভার ফাংশন ঠিক করতে সহায়তা করে।
অ্যাপেল সিডার ভিনিগার : এক কাপ গরম পানিতে কয়েক ফোঁটা অ্যাপেল সিডার ভিনিগার মিশিয়ে প্রতিদিন খাবার আগে পান করুন। কয়েক মাস এটা খেলেই দেখবেন লিভারে জমে থাকা চর্বি সব গায়েব হয়ে গেছে।
আদাপানি : এক চা চামচ আদা গুঁড়া গরম পানিতে মিশিয়ে দিনে দুবার পান করুন। এই পানীয় টানা ১৫ দিন খেলেই দেখবেন অনেক সুস্থ বোধ করছেন। কারণ এটি লিভারে চর্বি জমার প্রক্রিয়াটি প্রায় বন্ধ করে দেয়। ফলে লিভার আস্তে আস্তে ঠিক হতে শুরু করে।
আমলার রস : আমলায় ভিটামিন-সি থাকায় এটি লিভারকে দূষণমুক্ত করে। তাই লিভারের অসুখে আক্রান্ত রোগী যদি টানা ২৫ দিন এই রস, এক চামচ করে প্রতিদিন সকালে খান, তাহলে তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।
এই সহজ উপায়গুলি অনুসরণ করে আমরা আমাদের লিভারকে সুস্থ রাখতে পারি এবং লিভারের রোগের ঝুঁকি কমাতে পারি। লিভার আমাদের শরীরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি শরীরের বিষাক্ত পদার্থ অপসারণ, হজম প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ, এবং রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে। তাই লিভার সুস্থ রাখা অত্যন্ত জরুরি।